শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
বর্তমান আধুনিক সমাজের একটা শ্রেণী ইসলামিক আইন ব্যবস্থা এবং মানুষের স্বাধীনতাকে মুখোমুখি দাড় করানোর ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন ‘ইসলামিক আইন ব্যবস্থা বা ইসলামিক দল ক্ষমতায় আসলে মানুষের স্বাধীনতা হরণ ও খর্ব হবে’। তারা অতি সুকৌশলে যুবক-যুবতীদের মনে একটি গভীর ভুল ধারণা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করছেন—ইসলাম মানেই পরাধীনতার জীবন। একজন মুসলিমের জীবনে কোনো স্বাধীনতা বা স্বাচ্ছন্দ্য নেই। ইসলাম শক্তি, বিজ্ঞান, উন্নতি ও প্রগতির শত্রু। ইসলাম মানেই স্বাধীনতার অভাব, মানবাধিকারের সংকোচন এবং অগ্রগতির পথে বাধা।
এই ভুল ধারণার কারণে অনেকেই ইসলামের আসল রূপ না জেনেই দূরে সরে যাচ্ছেন, ধর্মকে কেবল পশ্চাদগামীতা ও অবনতির প্রতীক মনে করছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি নিছক সন্দেহ ও ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলাম মানুষের জন্য মুক্তির, জ্ঞানের ও প্রগতির ধর্ম।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে আইন সর্বদা মানুষের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই এসেছে। কিন্তু আইন মানেই অনেকের কাছে যেন শাস্তি আর ভয়। বিশেষত ইসলামিক আইনকে নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা আছে—এটি কঠোর, এটি স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে। বাস্তবে সত্য ভিন্ন। ইসলামিক আইনকে ভয় পায় মূলত সেই শ্রেণীর মানুষ যার অন্তরে পাপের বোঝা রয়েছে।
মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা হলো অন্যায় করলে শাস্তির ভয় পাওয়া। এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় আইনকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা। কিন্তু ইসলামিক আইন কেবল শাস্তির বিধান নয়; বরং এর মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ প্রতিরোধ, দুর্বলদের অধিকার রক্ষা এবং সমাজে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। ইসলামিক আইনব্যবস্থা তাই প্রতিটি রায় দেওয়ার আগে দেখে, অপরাধীর দায় কতখানি? তার সামাজিক প্রেক্ষাপট কী? এবং সে কি ন্যায্য সুযোগ পেয়েছিল?
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়কালে আরব সমাজ ছিল অজ্ঞতা, অন্যায় ও অনৈতিকতায় নিমজ্জিত—ইসলামের আলোয় তা খুব অল্প সময়েই বিজ্ঞান, সভ্যতা ও নৈতিকতার দৃষ্টান্তে রূপ নেয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও আমরা দেখি ন্যায়বিচার, প্রশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতিতে মুসলিম সমাজ দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যায়।
ইসলামিক আইনের বাস্তব রূপ প্রথম প্রতিফলিত হয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময়েই। তিনি শুধু শাস্তি দেননি, বরং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য সমাজে ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন।
নারীর মর্যাদা: আরব সমাজে নারী ছিল অবহেলিত ও বঞ্চিত। কিন্তু ইসলামিক আইনের মাধ্যমে মহানবী (সা.) নারীদের উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, বিবাহ ও সামাজিক মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আজ যখন নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখনই বোঝা যায় ইসলামিক আইন আসলে কতটা অগ্রসরমান।
চুরি প্রসঙ্গে: একবার এক সাহাবি চুরির দায়ে ধরা পড়লে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার পরিবার অনুরোধ করেছিলেন, যেন তিনি ক্ষমা করে দেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “আমার কন্যা ফাতেমা যদি চুরি করত, তবে তাকেও আমি শাস্তি দিতাম।” (সহীহ মুসলিম)। এখানে স্পষ্ট হয়— ইসলামিক আইন কারও জন্য ছাড় দেয় না, ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সবার সমান মর্যাদা।
খলিফাদের যুগেও ইসলামিক আইন শুধু শাস্তি নয় বরং ন্যায়বিচার ও মানবিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামল (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামিক আইন ও ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর শাসনকালকে ইতিহাসে সুবর্ণ অধ্যায় বলা হয়।
সমতা প্রতিষ্ঠা: একবার উমর (রা.) মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন এক সাধারণ সাহাবি দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা শুনব না, যতক্ষণ না বলবেন আপনার শরীরে যে কাপড় আছে তা কোথা থেকে এল।” কারণ রাষ্ট্রীয় বন্টনের কাপড় সবার জন্য সমান ছিল, অথচ তাঁর পোশাক বড় দেখাচ্ছিল। উমর (রা.)-এর ছেলে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করলেন যে তিনি নিজের অংশ বাবাকে দিয়েছেন। তখনই লোকেরা নীরব হয়। এ ঘটনা প্রমাণ করে ইসলামিক আইনের অধীনে শাসকও জবাবদিহির বাইরে নন।
অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা: উমর (রা.) এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন ভিক্ষা করছে। তিনি তখন বায়তুল মাল থেকে তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করলেন এবং বললেন—“আমরা তরুণ বয়সে তার থেকে কর নিয়েছি, বার্ধক্যে তাকে অবহেলা করা যাবে না।” ইসলামিক আইনের অধীনে অমুসলিমদের এই ধরনের সুরক্ষা আজও মানবাধিকার শিক্ষার উদাহরণ হতে পারে।
দুর্ভিক্ষের সময় শাস্তি স্থগিত: খলিফা হযরত উমর (রা.) দুর্ভিক্ষের সময় চুরির হদ শাস্তি স্থগিত করেছিলেন। কারণ তিনি বলেছিলেন—যখন মানুষ ক্ষুধার্ত, তখন তারা অপরাধে বাধ্য হয়; তাই রাষ্ট্র আগে নাগরিকদের আহারের নিশ্চয়তা দেবে। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামিক আইন অন্ধভাবে শাস্তি দেয় না, বরং পরিস্থিতি ও ন্যায়বিচার বিবেচনা করে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: উমর (রা.) ক্বাজিদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন। বিচারকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন—“কোনো মামলা নিষ্পত্তির সময় খলিফা আমি হলেও পক্ষপাত করবে না।” ফলে সাধারণ মানুষও ন্যায়বিচার পেতো।
আজকের সমাজে দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার যখন ব্যাপক আকার নিচ্ছে, তখন ইসলামিক আইনকে ভয় পায় মূলত সেই মানুষ, যারা এই অপরাধগুলো করে বেঁচে থাকতে চায়। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, অর্থপাচারকারী ব্যবসায়ী কিংবা নারী নির্যাতনকারী—তাদের কাছে ইসলামিক আইন আতঙ্ক। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে, বিশেষত নিপীড়িতদের কাছে, এটি নিরাপত্তা ও আশ্বাস।
ইসলামিক আইনকে যদি কেবল শাস্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, তবে তা একটি সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি। প্রকৃতপক্ষে, এটি মানবিক ন্যায়বিচার, অপরাধ প্রতিরোধ এবং দুর্বলদের অধিকার রক্ষার সুরক্ষা-কাঠামো।
অতএব বলা যায়, ইসলামিক আইনকে ভয় পায় তারা, যারা নিজেদের অন্যায়কে আড়াল করতে চায়। ইসলামের সাথে পশ্চাদগামিতা বা পরাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি একটি মুক্তির বার্তা—মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয়, অবনতি থেকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা। আজকের যুব সমাজের উচিত হবে সন্দেহে ভেসে না গিয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সাথে পরিচিত হওয়া।